গর্ভকালীন সময়ে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হলো গ্যাসের সমস্যা। এটি যেকোন সময়, যেকোন মানুষের জন্যই অনেক বেশি অস্বস্তির হতে পারে। আর গর্ভাবস্থায় গ্যাসের সমস্যা আরো বেশি করে ঘটে থাকে বলে মা শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে কিছুটা হীনমন্যতায় ভুগে থাকেন। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের পেটে প্রতিদিন ১ থেকে ৩ পিন্ট গ্যাস উৎপন্ন হয়। এবং দিনে একজন মানুষ সাধারণত ১২-১৪ বার ঢেঁকুর তোলে বা বায়ু ত্যাগ করে।
কারো কারো ক্ষেত্রে গ্যাস বলতে বোঝায় বদহজমের কারণে পেটে ফোলা ভাব, তবে বেশীর ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে বায়ু ত্যাগ করাকেই গ্যাস বলে। বায়ু ত্যাগ করাকে ডাক্তারি ভাষাতে বেশীরভাগ সময় flatulence নামে অভিহিত করা হয়। গ্যাস flatulence এর মাধ্যমে বা ঢেঁকুরের মাধ্যমে শরীর থেকে বেড়িয়ে যায়।
গ্যাস কেন হয়?
গ্যাস সাধারণত দুভাবে পরিপাক নালীতে জমা হয়। যখন মুখ দিয়ে বাতাস ভেতরে ঢোকে এবং যখন বৃহদান্ত্রে ব্যাকটেরিয়া হজম না হওয়া খাবার ভাঙ্গতে থাকে। মুখ দিয়ে ঢোকা বেশীরভাগ বাতাস সাধারণত ঢেঁকুরের মাধ্যমে বেড়িয়ে যায় তবে অল্প কিছু বাতাস বৃহদান্ত্রে রয়ে যায় এবং বায়ু ত্যাগের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়। বায়ু ত্যাগের মাধ্যমে যেসব গ্যাস বের হয় তার বেশীর ভাগই তৈরি হয় যখন বৃহদান্ত্রের ব্যাকটেরিয়া আমাদের পাকস্থলীর অ্যানযাইম দ্বারা ও খুদ্রান্তে পরিপূর্ণ ভাবে হজম না হওয়া খাদ্য ভাঙ্গতে শুরু করে।কিছু কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য গ্যাস হওয়ার প্রধান কারণ। প্রোটিন ও ফ্যাট সরাসরি খুব কম গ্যাস উৎপন্ন করে। তবে ফ্যাটের কারণে পেটে ফোলাভাব হতে পারে কারণ তা হজম প্রক্রিয়া মন্থর করে দেয়।
কোন নির্দিষ্ট খাবার যে সবার ক্ষেত্রে গ্যাসের কারণ হবে তা কিন্তু নয়। কিছু খাবার কারো অনেক গ্যাসের সৃষ্টি করতে পারে আবার ঠিক একই খাবার অন্যদের কোন অসুবিধার কারণ নাও হতে পারে। যেমন যারা ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্ট তারা দুধ বা দুধের তৈরি কিছু খেলেই গ্যাসের সমস্যায় পড়েন, কারণ তাদের শরীর দুধের ল্যাকটোজ ভাঙ্গার জন্য প্রয়োজনীয় অ্যানযাইম তৈরি করতে পারেনা। এছাড়াও মানুষের কোলোনে ( Colon) ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্যের উপর ও গ্যাস হওয়া না হওয়া নির্ভর করে।
গর্ভাবস্থায় গ্যাসের সমস্যা বেশী হয় কেন?
গর্ভাবস্থায় গ্যাসের সমস্যা বেশী হওয়ার প্রধান কারণ হলো প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া। প্রোজেস্টেরন হরমোনের কারণে মায়েদের শরীরের পেশীগুলো শিথীল হয়ে পড়ে। যেহেতু পরিপাকতন্ত্রের পেশিগুলোও শিথীল হয়ে পড়ে, ফলে মায়েদের খাবার হজম ধীরে হয়। এর ফলে শরীরে গ্যাস সহজে বাড়তে থাকে এবং ঢেঁকুর বা বায়ু ত্যাগের মাধ্যমে বেড়িয়ে আসে। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে যখন বর্ধিত জরায়ু অ্যাবডোমিনাল ক্যাভিটিতে চাপ সৃষ্টি করে তখন এ সমস্যা আরও বাড়তে পারে।সবচাইতে অস্বস্তিকর বিষয় হোল প্রোজেস্টেরন হরমোনের বৃদ্ধির কারণে পেশীতে যে শিথিলতা দেখা দেয় তার ফলে বায়ু ত্যাগ নিয়ন্ত্রন করা কষ্টকর হয়ে ওঠে যার ফলে হয়তোবা কখনো অন্য কারো সামনে অস্বস্তিতে পড়ে যেতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় গ্যাসের সমস্যা প্রতিকারের উপায় কি?
গর্ভাবস্থায় গ্যাসের সমস্যা পুরোপুরি দূর করা প্রায় অসম্ভব। তবে কিছু কিছু উপায় অবলম্বন করে আপনি তা নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারেন। যেহেতু আপনি কি ধরনের খাবার খাচ্ছেন তার উপর নির্ভর করে পেটে গ্যাস হতে পারে তাই কিছু কিছু খাবার খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিয়ে গ্যাস নিয়ন্ত্রনে রাখা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে গ্যাস হয় এমন সব কিছু বাদ দিলে গর্ভাবস্থায় শরীর পরিপূর্ণ পুষ্টি নাও পেতে পারে। তাই খেয়াল রাখুন কোন খাবারে খুব বেশী সমস্যা হচ্ছে এবং শুধুমাত্র সে খাবারগুলো পরিহার করার চেষ্টা করুন।
সাধারণত যেসব খাবার গ্যাসের সমস্যা হয় সেগুলো হোলঃ
ডাল ও ডাল জাতীয় খাদ্য
ডাল, বুট, ছোলা, বীণ, সয়াবিন ইত্যাদি ধরণের খাবার গ্যাস উদ্রেককারী খাবার। এগুলোতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, সুগার ও ফাইবার যা সহজে হজম হতে চায় না। ফলে গ্যাসের সমস্যা সৃষ্টি করে পেটে।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার পর যদি দেখেন পেটে গ্যাস হচ্ছে তার অর্থ হচ্ছে আপনি লাক্টোজ ইন্টলারেন্ট অর্থাৎ আপনার দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার হজমে সমস্যা রয়েছে। হজম হয় না বলেই এগুলো আপনার পেটে গ্যাস উদ্রেকের জন্য দায়ী।
মটরশুটি
মটরশুটির মধ্যে রয়েছে প্রোটিন, আঁশ ইত্যাদি। এটি কখনো কখনো পেট ফোলাভাব বা পেটে গ্যাস তৈরি করতে পারে। এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে রান্নার আগে মটরশুটিকে সারা রাত পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। এতে মটরশুটি সহজে হজম হবে।
রসুন
রসুন খাওয়ার পর অনেকেরই পেট ফোলাভাব বা গ্যাসের সমস্যা হয়। রসুনের মধ্যে রয়েছে প্রচুর স্বাস্থ্যকর উপাদান। তাই পেটে গ্যাস হবে ভেবে একে এড়িয়ে যাবেন না। পেটের ফোলাভাব প্রতিরোধে রসুন রান্না করে খান; কাঁচা খাবেন না। গ্যাস থেকে মুক্তি পাওয়ার এটি সবচেয়ে ভালো উপায়।
পেঁয়াজ
কাঁচা পেঁয়াজ গ্যাসের সমস্যা তৈরি করে। এই সবজিটির মধ্যে রয়েছে অনেক স্বাস্থ্যকর উপাদান। তাই গ্যাসের সমস্যা এড়াতে একে রান্না করে খান।
ব্রকোলি ও বাঁধাকপি
এই খাবারগুলো স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। তবে এগুলোও কিন্তু পেটে গ্যাসের সমস্যা তৈরি করতে পারে। এগুলো আঁশ, আয়রন, ভিটামিন এবং মিনারেলসমৃদ্ধ খাবার। তবে যদি খাবারগুলো আপনাকে ঝামেলা করে বিকল্প হিসেবে শসা, পালং শাক ইত্যাদি খেতে পারেন।
খাবার দাবার নিয়ন্ত্রন করা ছাড়াও এখানে কিছু সাধারন পরামর্শ দেয়া হোল যা খাবার ভালো ভাবে হজম হতে সাহায্য করার পাশাপাশি পেটের গ্যাস ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করবে।
- পেটে গ্যাস হওয়ার সমস্যা থাকলে ৩ বেলা বেশি করে খাবার পরিবর্তে কম সময়ের বিরতি দিয়ে কম খাবার বার বার খান।এভাবে খেলে খাবার সঠিক ভাবে হজম হবে এবং গ্যাস হওয়ার সমস্যা কমবে।
- পেট ফুলে থাকা বা গ্যাসের সমস্যা সাধারণত হয়ে থাকে খাবার ভালো ভাবে হজম না হওয়ার কারনে। ভালো করে চিবিয়ে খাবার খেলে তা সহজে হজম হয়।কারন খাবার হজমের প্রথম ধাপ শুরু হয় চর্বণ প্রক্রিয়ায় খাবার ভেঙ্গে লালার সাথে মিশে যাওয়ার মাধ্যমে।খাবার সময় কথা না বলার চেষ্টা করুন।
- পেটে গ্যাস হওয়া কমাতে চাইলে ধীরে খাবার খান। কারন যখন খুব দ্রুত খাবার খাওয়া হয় তখন খাবারের সাথে কিছু বাতাসও পেটে ঢুকে যায় এবং ফোলা ভাবের সৃষ্টি করে।
- খাওয়ার সময় বেশী পানি না খেয়ে সারাদিন প্রয়োজনীয় পানি পান করার চেষ্টা করুন। গ্লাস বা কাপে ঢেলে পানি পান করুন। বোতল থেকে বা স্ট্র দিয়ে পানি না খাওয়ার চেষ্টা করুন। এতে পানির সাথে সাথে বাতাস ও পেটে ঢুকে যায়। পানি খাওয়ার সময় ছোট ছোট ঢোকে পানি খাওয়ার চেষ্টা করুন।
- কার্বনেটেড ড্রিংকস বর্জন করুন। এসব পানীয়তে কার্বন ডাই অক্সাইড থাকার কারনেই বুদবুদের সৃষ্টি হয় আর এগুলো খেলে পেটে আটকে থেকে পেট ফুলে যায় এবং গ্যাসের সৃষ্টি হয়। তাই সব সময় চেষ্টা করতে হবে এইসব চিনি জাতীয় ও কার্বনেটেড পানীয় গুলো না খেয়ে শুধু পানি পান করার।
- খাবার সময় বা পান করার সময় তা বসে করার চেষ্টা করুন, এমনকি ছোট কোন স্ন্যাক খাওয়ার সময়ও বসে পড়ুন।
- এই সময় টাইট ফিটিং সব কাপড়চোপড় বা বেল্ট পড়া এড়িয়ে চলতে হবে।
- চুইংগাম যথাসম্ভব না খাওয়াই ভালো।
- কর্মক্ষম থাকতে চেষ্টা করুন। দিনে আধা ঘণ্টা হাঁটলেও গ্যাস এর সমস্যা অনেকাংশে কমে যেতে পারে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে তা নিরাময়ের চেষ্টা করুন। কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে গ্যাসের সমস্যা বাড়তে পারে।
যদি খুব বেশি সমস্যা হয় তবে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। তবে যে কোন ওষুধ সেবনের আগেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
Comments
Post a Comment